মাটির টানে
Ceramic black pottery

মাটির টানে

সেই কোন কালে কবি লিখেছিলেন – “মাটিতে জন্ম নিলাম মাটি তাই রক্তে মিশেছে।” সত্যই মাটি না থাকলে আমরাও নেই। মাটিই আমাদের নিকটতম এক মাধ্যম যা সাধারণ জন থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল শিল্পীর আত্মউন্মোচনের সুযোগ করে দেয়। এরকমই এক উচ্চমার্গের মৃৎশিল্প বা মাটিমাধ্যম হলো সেরামিক, যা প্রকৃতিজাত, মাটি থেকেই আমরা পেয়ে থাকি। যদিও এক্ষেত্রে ব্যবহৃত টেকনিকের কারণে সেরামিক এক অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয় তবুও সমস্ত রকম সম্ভাব্য রূপান্তরকে মাথায় রেখে সেরামিক শিল্পীরা নিজ নিজ ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমকে এক উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

 

মাটির টানে
অতি সম্প্রতি এই শহরের ‘ছবি ও ঘর’ আর্ট গ্যালারিতে পাঁচজন তরুণ শিল্পীর সেরামিক ভাস্কর্য ও পটারীর প্রদর্শনী হয়ে গেল। শিল্পীরা ছিলেন – আশীষ চৌধুরী, দেবজিৎ চক্রবর্তী, সুদীপ্ত সাহা, ঝুমা কুন্ডু এবং সৌভিক দাস। শিল্পীরা প্রত্যেকেই স্ব ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল, নিষ্ঠ ও যত্নবান, প্রত্যেকেই নিজস্ব চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ।
আশীষ চৌধুরী মুলতঃ সহজ সরল আকার বা ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। বাহুল্যবর্জিত একধরনের সরলীকরণের মধ্যে তিনি পশুপাখির ফর্ম ও রিদম্ ধরেছেন। যা তাঁর কাজে খানিকটা বিমূর্ততা এনেছে, এক্ষেত্রে প্যাঁচার কাজটি উল্লেখযোগ্য। আবার দশভূজা মাতৃমূর্তির ক্ষেত্রে ঘটের বা কলসের আকার কেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আমরা জানি ঘট বা কলস মাতৃমূর্তির প্রতীক হিসাবে সুপ্রাচীন কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় – মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলে অঘ্রাণ পৌষ মাসে ছোট ছোট পোড়ামাটির ঘটে সিংহাসনে রেখে বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজা হয়। ঘটের মুখটির কাছে লক্ষ্মী এবং গণেশের মুখের একটু ইঙ্গিতমাত্র। এই অতিমাত্রিক সরলতা বিষ্ময় উদ্রেক করে। এই বিমূর্ততা কাল পেরিয়ে সমানভাবে আজও বিদ্যমান।

Ceramic rose

ঝুমা কুন্ডু তিনি ভ্রমণ পিয়াসী, অনেক দেখেছেন, অনেক জেনেছেন। প্রাচীন মরুদেশ মিশরের মৃত্যুতত্ত্ব তাঁর শিল্পীমনের অন্তর্লোকে কোথাও যেন ছাপ ফেলে গেছে। যা তাঁর ‘ডেথ সিরিজ’ নামক কাজে প্রকাশ পেয়েছে – এই কাজটিতে কালো কাঁচের ভূমি স্পর্শ করে তিনটি সিংহাসন যেগুলির পীঠ শোভিত রয়েছে লাল গোলাপে, সুন্দর কম্পোজিশন। সিংহাসন সততই ক্ষমতার দ্যোতক, আর তার নীচে থাকা কালো কাঁচ নেতিবাচক পরিস্থিতি বোঝায়। গোলাপ সুন্দর কিন্তু কন্টকময়। সিংহাসনে বিছানো লাল গোলাপ…. ক্ষমতা লোভ কামনা, আসলে যা মৃত্যুর ইঙ্গিতবহ। ঝুমার এই কাজটি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।

ceramic plate
দেবজিৎ চক্রবর্তী তিনি ভেবেছেন মানবমনের অন্তর্লোক নিয়ে যেখানে সবাই নিঃসঙ্গ পথিক, একাকী। এরকম এক মানব অস্তিত্ব যা বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন মানসিক অবস্থানে উপনীত হচ্ছে, কোথাও বা তা নিঃসীম শূণ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, অথবা নিরাপত্তাহীনতা মানব অস্তিত্বকে একেবারে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। ক্ষয় হচ্ছে বিভিন্নভাবে। দেবজিৎ তিনি নির্দিষ্ট একটি মুখকে প্রতিকী হিসেবে নিয়েছেন এবং ক্ষয়ে যাওয়া ভেঙে যাওয়া এক একটি অবস্থা ও অবস্থানকে ধরার চেষ্টা করেছেন। দেওয়ালে ঝোলানো নীল সবুজ প্লেটগুলি যেনো অনন্ত অসীম ব্রক্ষ্মান্ড আর তারামণ্ডলের সমাহার। গোলাকার প্লেটে যা কেবল নীল সবুজ টেক্সচার, কিন্তু যার ব্যপ্তি বিশাল। দেবজিতের এই সিরিজের কাজগুলি ব্যক্তির অন্তর্লোকের দন্দ্ব আর অসহায় নতিস্বীকারকে মনে পড়ায়।

Ceramic large vase
সুদীপ্ত সাহার কাজগুলিতে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হলো দূর অতীত আর আধুনা বর্তমানে ক্রম যাতায়াত তথা সচ্ছন্দ যোগাযোগ। বলা যেতে পারে সভ্যতার ইতিহাসে সেরামিক হলো প্রাচীনতম শৈল্পিক প্রকাশ, যা বহন করে চলেছে সামাজিক ধর্মীয় রীতিনীতি। আবার ব্যবহারিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু। শিল্পী সুদীপ্ত টার্কিজ ব্লু ব্যবহার করেছেন। চমৎকার দৃষ্টিনন্দন বিশাল ব্লু ভাস যার বহিঃগাত্র সাদা পুঁতি কড়ি ইত্যাদি দিয়ে অলংকরণ করা হয়েছে, বিশেষ করে ব্লাক পটারীর লম্বাটে ডিম্বাকৃতি আর সরু লম্বা গলার ডিজাইন আরব্যরজনীর গল্পবহ। দূর অতীতের অনুভূতি তৈরি করে। এছাড়াও দেওয়ালে ঝোলানো বড়ো বড়ো নীল রঙে ঘূর্ণায়মান কাজগুলি আকর্ষণীয়। এগুলির মাঝখানে সাদা পুঁতি কড়ির অলংকরণে মনে হয় সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা খানিকটা সাদা ফেনা আর নীল জল ফুলের আকার ধারণ করেছে। এই কাজগুলিও বেশ দৃষ্টি সুখকর।

মাটির টানে
সৌভিক দাস এই দলে কনিষ্ঠ শিল্পী, তাঁর কাজ স্বাভাবিক তারুণ্যে ভরা। সকালের রোদের মতো স্বাভাবিক ও উজ্জ্বল। নরম রোদের মতোই সুন্দর গ্লেজড পটারীগুলি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কাজ করেছেন খুব স্বাভাবিক ছন্দে। তেমনি ভাস্কর্যে তিনি কল্পনাশ্রয়ী, পৃথিবী ও ব্রক্ষ্মান্ডের মাঝখাতে একফোঁটা শিবলিঙ্গ, আবার প্রিহিস্টরিক পাথুরে গুহাগাত্র তাঁর অন্য আর একটি চিন্তার জগতকে চিনিয়ে দেয়।

এই তরুণ শিল্পীদের প্রতি অনেক শুভেচ্ছা রইলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More
articles

Visit ARTWORKS

Bappa Bhowmick
Title: Untitled
SURAJIT ROY
Title: CONTEMPORARY SYMBOL
Ankita Dutta
Title: Untitled

Thank you for showing interest, please send us a message

Your Name*
Email*
Phone*
Your Message*