আলিপনা বা আলপনা, উৎস সংস্কৃত শব্দ 'আলেপন' অর্থ প্রলেপ দেওয়া বা লেপন করা। চালের গুঁড়ো বা খড়িমাটি জলে গুলে অনুষ্ঠানে মাঙ্গলিক হিসেবে তা আঁকা হয়। তাতে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রীর সরল উপস্থাপনা। বস্তুত আলপনা গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক রত্ন ভান্ডারী নিদর্শন। শহরের আগ্রাসন যত বেড়েছে তত হরেক গ্রামীণ শিল্পকলার মতন আলপনা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে না মেলে গ্রাম বাংলার গোবর নিকোনো উঠোন বা না পাওয়া যায় লাল মাটির মেঝে। তাই হারিয়ে যাওয়া এই প্রাচীন শিল্পকে পুনরুদ্ধার করতে তথাপি আলপনা এই কলা কে স্থায়ী রূপ দিতে আগামী ১৯ শে মে থেকে চৌঠা জুন ছবি ও ঘর আর্ট গ্যালারি সেজে উঠবে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী আলপনার সাজে। বিধান বিশ্বাস একজন আলপনা গবেষক। তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলপনার খোঁজে। তিনি খুঁজে বেড়ান বিভিন্ন উৎসব পার্বণ রীতিনীতি যেখানে আজও বাংলার উঠানে গোবর লেপে আলপনা দেয়া হয়। বিধানদার তুলিতে ফুটে উঠেছে সেই সব উঠোনের সাজ। শৈশবে বাড়িতে নানা পার্বণে মা ঠাকুমাদের আলপনা দেবার চল এবং প্রতিনিয়ত তা দেখার অভ্যাস থেকেই মূলত আলপনার সঙ্গে একাত্ম হওয়া শিল্পী বিধান বিশ্বাসের। পশ্চিম সীমান্ত বাংলার মেয়েরা নানারকম নকশা বা আঁকাআঁকি করেন দেওয়ালে আবার পূর্ববঙ্গের মানুষের কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো ও পৌষ পার্বণে আলপনা দেবার রীতি - এই ধরণের লৌকিক আমেজ বা চিত্র কলার একটা দিক যা সহজে অনুধাবন বা অনুশীলন করার সময় পাওয়া যায় না- তা নিয়ে চর্চা করার এক অমোঘ আগ্রহ ছিল শিল্পীর।
গোবর লেপা হাতে তৈরি কাগজে পরবর্তীতে লাল মাটি লাগিয়ে জমি তৈরি করে তার ওপর খড়িমাটি দিয়ে আলপনার নকশা ফুটিয়ে তুলতেন তিনি। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে শিল্পী নানাবিধ ব্রত কথা ভিত্তিক ঠাট বা ইংরেজি প্রতিশব্দ তুলে আনেন তার আলপনার চরিত্র হিসেবে। ১৯৮৫ সালে রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি থেকে ভিজুয়াল আর্টসের উপর ডিপ্লোমা করার পর তিনি প্রায় 6 বছর বাংলার লোকসংগীত এর চর্চা করেছিলেন। সেই সুবাদে তিনি স্বনামধন্য লোকসংগীত শিল্পী কালিদাস গুপ্তের সাহচর্য পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন বাংলার লোকনাট্যের সঙ্গে। শিল্পী বিধান বিশ্বাস শুধুমাত্র আলপনার সূত্র খোঁজা বাহ আঁকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি তা নয় বরং আমরা তাকে লেখক হিসেবেও দেখতে পাই বিভিন্ন লোকশিল্প এবং কারুশিল্পের বইয়ের পাতায়। তিনি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র ও মাসিক পত্রিকায় বাংলা লোকশিল্প এবং তার নানাবিধ মোটিভ নিয়ে লেখনীর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চা করে গেছেন। ভারতবর্ষ এবং তার বাইরে তিনি প্রায় 76 টি চিত্র প্রদর্শনী তে অংশগ্রহণ করেছেন বাংলার লোকশিল্পের অগ্রগতির উদ্দেশ্যে। একজন আলপনা শিল্পী ও গবেষক হিসেবে 1995 সাল থেকে তিনি বহু কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন করেছেন। বিবিধ প্রদর্শনী বা কর্মশালার মধ্য দিয়ে আলপনার প্রসার বিস্তার করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিসে বা গৃহ শয্যায় অর্থাৎ যাকে বলা হয় ডিমেনসন তাতে সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার ছোঁয়া আনতে তাকে দৃষ্টিনন্দন করতে আলপনার ব্যবহার করেন তিনি যেমন নোটবুক ব্যাগ কাঠের বারকোষ মাটির ভার মাটির লক্ষ্মীসরা বাসের কুনকে এগুলোতে লাল মাটি লেপে সনাতনী আলপনা দেওয়া হয়। ছবিও ঘর এ আগামী 19 মে থেকে চৌঠা জুন অব্দি অনুষ্ঠিত "বাংলার আলপনা' একক প্রদর্শনীতে আমরা শিল্পী বিধান বিশ্বাসের আলপনার আকরে রাঢ়বাংলার অজস্র প্রচলিত ব্রতকথায় ব্যবহৃত মোটিফকে খুঁজে পাৰ। যেমন পুন্যি পুকুর ব্রত ভাদুনি ব্রত এই সকল ব্রততী ব্যবহৃত বিভিন্ন লতা যেমন পদলতা বেশি ধানলতা কলমি লতা, গঙ্গা যমুনা জলের প্রতিকূলতা এছাড়া পদ্মের পাপড়ি,একমাথা দুই পাখি এই ধরনের নানাবিধ প্রতীককে আমরা খুঁজে পাবো শিল্পী র হাতে প্রস্তুত গোবর- লাল মাটি লেপা কাগজে খড়ি মাটির আলপনার সনাতনী ধারায়। এছাড়াও প্রতিদিন বিধানদা উপস্থিত থাকবেন আলপনা শেখানোর জন্য। বৰ্তমানে তার এই অসীম কর্মযজ্ঞ বাংলার লুপ্তপ্রায় আলপনাশিল্পের বেঁচে থাকার এক অনন্য প্রয়াসLeave us a message